ভালোবাসার ব্যবচ্ছেদ ও রসায়ন !

শামসুল হক রাসেল | ১২ জুন ২০১৫ | পড়া হয়েছে 3049 বার

আগামীকাল বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই ভালোবাসার ব্যবচ্ছেদ ও রসায়ন জানাটা জরুরি। মনে রাখতে হবে, বাধা পেলেই আরও ঘনীভূত হয় ভালোবাসার তেজ। সামনের পথ রুদ্ধ হলে গোপনে চলতে থাকে নীরব বিপ্লব। তাই তো ভালোবাসার জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে পরিবারের শান্ত-সৌম্য লাজুক কিশোর-কিশোরী। এমনকি বিবাহিতরাও পরকীয়া প্রেমের টানে ঘর ভেঙে বেরিয়ে যায়। সবকিছু চাপা পড়ে দানবীয় ভালোবাসার বেগবান শক্তির পদতলে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে লিখেছেন – শামছুল হক রাসেল (বাংলাদেশ প্রতিদিন)

ভালোবাসায় যেমনটি রয়েছে আবেগের ভূমিকা, তেমনি রয়েছে হরমোনসহ অনেক রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গোপন চাল। অন্তর্গত রাসায়নিক পরিবর্তন আমাদের চিত্তে ঝলসে ওঠে, পাল্টে দেয় জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রেম-রোমান্সের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার থাকে কামের নেশা। এ নেশা ও কাম তাই বিলীন হয়ে থাকে একই মুদ্রার দুই পিঠে। তখন সবকিছু আর আবেগের গণ্ডির মধ্যে থাকে না।
রাসায়নিক উপাদানের সুতীব্র টানে খুলে যায় আদিম খোলস। এমন একটি উপাদান হচ্ছে ইস্ট্রোজেন হরমোন। এটিকে স্ত্রী হরমোন বলা হয়। আর একটি হচ্ছে টেস্টোস্টেরন বা পুরুষ হরমোন। নারী-পুরুষের শারীরিক গড়ন নির্ভর করে এ দুটি হরমোনের আনুপাতিক হারের ওপর। শারীরিক গড়ন, কাম-তৃষ্ণা ছাড়াও রোমান্টিক আবেগ অনুভূতির সঙ্গেও রয়েছে ইস্টোজেন এবং টেস্টোস্টেরনের গোপন খেলা। রাসায়নিক উপাদানের বিক্রিয়ার ফলে প্রেম-ভালোবাসা এবং মানবিক তীব্র আবেগীয় অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়।

ভালোবাসার ব্যবচ্ছেদ ও রসায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, মূলত দু’জন মানব-মানবী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার কারণে একটি অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যান। এ বাঁধনে শক্ত গিঁট এঁটে দেয় এন্ডোরফিনস নামক রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সটোসিন নামক হরমোন। এন্ডোরফিনস দুজনার মাঝে শান্ত-সৌম্য নিরাপত্তার অনুভূতি জাগায়, উন্মাতাল ঢেউ জাগায় না। প্রধানত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে। কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। এদের প্রেম পাত্র থেকে পাত্রে সঞ্চারিত হয়। নতুন মুখ, নতুন চোখ, নতুন হাসি তুমুল উদ্দীপনায় আবার ব্রেইনকে উদ্দীপ্ত করে, নতুন করেই সমান মাত্রায় পী পদার্থের নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। নতুন প্রেমের জোয়ার পুনঃ উদ্যমে আবার চলে আসে এভাবেই। পক্ষান্তরে এন্ডোরফিনসের কারণে ভালোবাসায় স্থিতি আসে বিধায় প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি সয়ে নিতে পারে। হুট করে এদের ভালোবাসা চলে যায় না, বরং বদলায় না। তিনি আরো বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, অব্যাহত অকৃত্রিম দেহমিলনের ফলে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান দেহের ভেতর উৎপাদিত হয়। অক্সটোসিন তখন এন্ডোরফিনসের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এন্ডোরফিনস মনকে শান্ত করে, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা দূর করে। বিজ্ঞানীরা এ রাসায়নিক উপাদানকে মাদক জাতীয় নির্ভরতা বলে চিহ্নিত করেছেন। মাদকদ্রব্য যত বেশি নেওয়া হয় তত নেশা গাঢ় হয়, নির্ভরশীলতা ততই বেড়ে যায়। দেহমিলনও অনেকটা সে রকম। এ জন্যই অব্যাহত দেহমিলনকে দাম্পত্য বন্ধনের চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেক গবেষক। দৃশ্যমান বন্ধনের মূল পর্ব দেহমিলন হলেও মূল বন্ধনকে মহিমান্বিত করে অক্সটোসিন। এ রাসায়নিক উপাদানটিকে তাই অফুরন্ত ভালোবাসার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

এছাড়া ভালোবাসার আবেগ ও পরিণতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটুর কাছে। তিনি বলেন, যখন কোনো মানুষ প্রেম বা ভালোবাসায় জড়ায় তখন সে তুলনামূলক শান্ত থাকে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলতে গেলে সে সময়টা মানুষের প্যারাসিম্পেথিটিক অ্যাক্টিভিটিস বাড়ে। অর্থাৎ সে তখন অন্যের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও সদাচরণ বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় বুকের ধড়ফড় কমে। এতে করে ভালো ঘুম হয়। সব মিলিয়ে আচার আচরণে পরিবর্তন আসে। এমনকি মনের অজান্তে গুনগুনিয়ে গান গাইতে থাকে। তিনি আরো বলেন, ভালোবাসায় জড়ালে বা কাউকে মনে প্রাণে ভালোবাসলে এক কথায় প্রেমে পড়লে ব্রেন থেকে পিরোটরিন হরমন নিঃসরিত হয়। ফলে কাজকর্মে সতেজতা পাওয়া যায়। এ কারণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ভালোবাসা জরুরি।

পরিশেষে একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে একজনকে ভালোবেসে ফেললাম, বিশ্ব জয় করে নিলাম। এটিই বড় প্রাপ্তি নয়। আসল স্তম্ভ হচ্ছে, ভালোবাসা জাগ্রত হওয়ার পর এটি টিকিয়ে রাখারও প্রচেষ্টা থাকতে হবে ভেতরে ভেতরে। ভালোবাসা থেকেই ময়ুখের ভেতর একটি ছোট্ট চারাগাছ প্রোথিত হয়েছে। গাছটিকে বড় করতে হবে, ফুল ফোটাতে হবে গাছে। এ জন্য চাই পরিচর্যা।

মন্তব্য করতে পারেন এখানে...

আরও লেখা

সব লেখা