ক্রোধ দমনের বৈজ্ঞানিক কৌশল

শামসুল হক রাসেল | ১২ জুন ২০১৫ | পড়া হয়েছে 1357 বার

ক্রোধ বা রাগ জীবনের একটি বড় অনুষঙ্গ। কেউ অল্পতে রেগে যান, কেউ সহজে রাগই করেন না। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা অবদমিত ক্রোধ আমাদের ভালো থাকার পেছনের শত্রু। এটি মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সুসম্পর্ক নষ্ট করে। বিনষ্ট করে মনের শান্তি। বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামালের সঙ্গে কথা বলে ক্রোধ দমনের বৈজ্ঞানিক কৌশল সম্পর্কে লিখেছেন- শামছুল হক রাসেল

আমরা শান্তি চাই। সুখ চাই। ভালোবাসা চাই। চাই একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে। যথানিয়মে কি আমাদের সব চাওয়া পূরণ হয়? পাওয়ার অপূর্ণতার ফাঁক দিয়ে আমাদের ভেতর ঢুকে যায় রাগ, ক্রোধ। এখান থেকেই শুরু হয় অশান্তি। নষ্ট হয় সম্পর্ক।

ক্রোধের সময় কী ঘটে দেহে : ব্রেন সিগন্যাল পাঠায়। ঝড়োগতিতে নিঃসরণ ঘটে সক্রিয় হরমোন নর-এড্রিনালিন। * নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, গভীর হয়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। চোখের মণির স্ফীতি ঘটে। * দেহের অন্যান্য অংশ থেকে রক্তপ্রবাহ দ্রুত ছুটে আসে হৃদপিণ্ডে, ব্রেন ও পেশির দিকে। * হজমক্রিয়া থেমে যায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। * হাতের মুঠি বন্ধ হয়ে আসে, দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে আসে, পরিপাকতন্ত্র খামছে ধরে। * মূলত ক্রোধের সময় দেহমনে জেগে ওঠে ডেঞ্জার সিগন্যাল বা লালবাতি।

‘ম্যানেজিং এঙ্গার’ গ্রন্থের লেখক গিললিনডেন ফিল্ডের মতে, রাগ হচ্ছে দেহের স্বাভাবিক আবেগীয় ও দৈহিক প্রতিক্রিয়া। যখন কেউ থ্রেটের মুখোমুখি হয় তার রাগ হতেই পারে।

ক্রোধ প্রশমন : সাম্প্রতিক মনোগবেষণা থেকে জানা যায়, ক্রোধ পোষ মানানোর যেসব সনাতন পদ্ধতি চলে আসছিল তা সমালোচনার উধের্্ব নয়। দৈহিক ভঙ্গিমা যেমন বালিশে বা নরম কিছুতে পাঞ্চ করে রাগ ঝাড়ার যে কৌশলের প্রচলন আছে, সাময়িকভাবে পজেটিভ ফলাফল থাকলেও এসব পদ্ধতি মূলত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রবণতাই আমাদের বৈশিষ্ট্যে গেঁথে দেয়। রাগ প্রশমনের এ ধরনের কৌশলের উল্টা পিঠে এভাবেই আগ্রাসী আচরণের বীজ রোপিত হয়ে যেতে পারে আমাদের মাঝে। একটি বিষয় খোলাসা হওয়া দরকার। নতুন কৌশল বর্ণনায় রাগ অবদমিত করে রাখার বিষয়টিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। বরং রাগ পোষ মানানোর জন্য পরীক্ষিত নতুন এ গবেষণার বৈজ্ঞানিক কৌশলগুলো যথেষ্ট কার্যকর।

বর্তমান বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি চিকিৎসায় সাফল্যের সঙ্গে কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির সুনির্দিষ্ট প্রটোকল ব্যবহার করা হয়। ক্রোধের ক্ষেত্রেও একই কৌশলে রাগ শাসন করার কৌশল রপ্ত করা যায়।

নিজের চেষ্টায় ক্রোধ দমনে নতুন কিছু কৌশল

পরিস্থিতি সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে : অধৈর্য বা বিরক্তি সৃষ্টি করে এমন ঘটনাগুলো প্রথমে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করুন। নোট করে রাখুন। পরবর্তীকালে শান্ত থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে এঙ্প্রেস করুন। তাড়াহুড়ো বা সজোরে পরিস্থিতির ভেতর নিজেকে ছুড়ে দেওয়া নয়, অপরকে দোষারোপ করাও নয়, এমনকি বিতর্কিত শব্দ ব্যবহার করা থেকেও নিজের জিহ্বাকে শাসন করতে হবে এ সময়। মনে রাখুন, ক্রোধের সময় ছুড়ে দেওয়া শব্দগুলো আপনার দেহ ও মনে স্ট্রেস রিএকশন ঘটায়। এ রিএকশন মানেই দেহের ক্ষতি, মনের ক্ষতি, ব্রেনের ক্ষতি, হার্টের ক্ষতি। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করুন ওম ম ম! রিলাঙ্। রিলাঙ্।

দশ পর্যন্ত গণনা : উন্মত্ততার সময় এ প্রক্রিয়াটি চর্চা করার কৌশল রপ্ত করে নিন। ধীরে ধীরে চর্চা করতে হবে। গভীর টানে প্রশ্বাস নিন। ছাড়ুন নিঃশ্বাস। অথবা রাগ উতরে ওঠার ঘটনা থেকে মুহূর্তের জন্য দূরে সরিয়ে নিন নিজেকে। এর অর্থ এই নয় যে, পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে গেলেন। শান্ত হলেই আবার ফিরে আসুন। ঘটনাটি পুনরায় মূল্যায়ন করুন।

হাস্যরসের উপাদান : রসবোধই মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা থেকে আপনাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে। ঘটনার ভেতরই ঘুরপাক খেয়ে দেখুন কৌতুকের কিছু উপাদান পাওয়া যায় কিনা। রাগ তরল করার জন্য রসবোধ যে কোনো পরিস্থিতি থেকেই খুঁজে বের করা যায়।

চিন্তার গণ্ডি বাড়ান : কোনো কোনো চিন্তা নিজের মাঝে ক্ষোভ জাগাতে পারে। বিক্ষুব্ধ করতে পারে। প্রথমে চিন্তাগুলোর জটিল গিঁট থেকে বিকল্প চিন্তার পথ বের করে নিতে হবে। এরপর পাল্টা এগ্রেশন জাগে এমন পরিস্থিতিগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে হবে।

ক্রোধবিষয়ক বই রাখুন : যখন নিজের মাঝে ক্রোধের উন্মত্ততা জাগবে, ১০ ডিগ্রি রাগের স্কেলে, তা মেপে নিন। যদি স্কোর ৪ বা ততোধিক হয়, পরিস্থিতি বিষয়ক চিন্তা এবং দৃশ্যমান ইমেজগুলো নোট করে রাখুন। ক্রোধের মেয়াদকাল, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি কি কি, বিস্তারিত লিখে রাখুন। কী পদ্ধতিতে, কী পরিস্থিতিতে, কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, পুরো বিষয়টি তখন আপনার কাছে খোলাসা হয়ে যাবে।

নিজের প্রতি ফিরে তাকাতে হবে : ক্রোধের কারণে নিজ জীবনে কতটুকু মূল্য দিতে হয়েছে একবার নেড়েচেড়ে দেখুন। রাগের কারণে কি কোনো মধুর সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? ভেঙে গেছে? কর্মক্ষেত্রে কি কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে? ফলশ্রুতিতে কি কোনো ধরনের দৈহিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে? বাস্তব প্রমাণ হাতে এলে, মূল্যায়ন সঠিক হবে। নিজেকে সামাল দেওয়ার কৌশল ভেতর থেকেই আপনাকে তখন রক্ষা করবে।

মন্তব্য করতে পারেন এখানে...

আরও লেখা

সব লেখা